সংবাদ শিরোনাম

 

‘সাত কোটি বাঙালির ভালোবাসার কাঙ্গাল আমি। আমি সব হারাতে পারি কিন্তু বাংলাদেশের মানুষের ভালোবাসা হারাতে পারব না।’ -বঙ্গবন্ধু

আত্মসমর্পণকৃত পাকিস্তানি বিশাল সৈন্যবাহিনীকে ফিরে যেতে দেয়া এবং বঙ্গবন্ধুর আন্তর্জাতিক মিত্রদের ক্রমাগত কূটনৈতিক চাপের মুখে ভুট্টো নমনীয় হন। ২৯ ডিসেম্বর ১৯৭১ প্রথম বিশ্ব সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত হয়- বঙ্গবন্ধুকে মুক্তি দেয়ার কথা ভাবছেন ভুট্টো।

৮ জানুয়ারি ১৯৭২ সকালে হিথ্রো বিমানবন্দরে পাকিস্তানি একটি বিশেষ ফ্লাইট ৬৩৫-এ অবতরণ করে। এর কিছুক্ষণ আগে সকালের বিবিসি মর্নিং সার্ভিসে প্রথম ঘোষণা করা হয় বঙ্গবন্ধু মুক্ত হয়ে লন্ডনে আসছেন। হিথ্রো বিমানবন্দরে ভিআইপি লাউঞ্জে ব্রিটিশ সরকারের সম্মানিত অতিথি হিসেবে তাকে নিতে এসেছেন বৈদেশিক দফতরের কর্মকর্তারা ও দক্ষিণ এশিয়া বিভাগের প্রধান কর্মকর্তা ইয়ার মাদারল্যান্ড। সকালবেলা বিখ্যাত ক্ল্যারিজেস হোটেলে ওঠার পর ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী এডওয়ার্ড হিথ, আমেরিকার সিনেটর কেনেডি, ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী ও স্বাধীন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলেন। সাত সকালেই সেখানে ছুটে এসেছিলেন হ্যারল্ড উইলিয়াম (সে সময়ের ব্রিটেনে বিরোধী দলের নেতা, যিনি পরবর্তী সময়ে ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন)। অতঃপর ক্ল্যারিজেস-এ প্রেস কনফারেন্সে বঙ্গবন্ধু বিশ্ববাসীকে জানিয়েছিলেন তার বিজয়ের বার্তা-মুক্তির বার্তা। ক্ল্যারিজেস-এ উপস্থিত বাঙালিদের কেউ চোখের পানি ধরে রাখতে পারছিলেন না। বঙ্গবন্ধু বারবার জিজ্ঞাসা করছিলেন শহীদদের কথা, দেশের কথা, ধ্বংসের কথা।

ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী সরকারি সফর সংক্ষিপ্ত করে লন্ডনে ফিরেন শুধু বঙ্গবন্ধুকে সম্মান জানাতে। বিকাল ৫টায় ১০ নম্বর ডাউনিং স্ট্রিটে বৈঠকের পর সব ধরনের রীতি উপেক্ষা করে ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী এডওয়ার্ড হিথ বঙ্গবন্ধুকে বহন করা গাড়ির দরজা খুলে দাঁড়িয়েছিলেন এ মহান নেতার প্রতি বিনম্র সম্মান জানাতে। এডওয়ার্ড হিথকে এজন্য ব্রিটিশ পার্লামেন্টের উচ্চকক্ষ হাউস অব লর্ডসে প্রশ্নবিদ্ধ হতে হয়। জবাবে হিথ বলেছিলেন, ‘আমি জানি কাকে সম্মান জানিয়েছি, তিনি হচ্ছেন একটি জাতির মুক্তিদাতা মহান বীর। তাকে এ সম্মান প্রদর্শন করতে পেরে বরং আমরাই সম্মানিত হয়েছি।’

পরদিন ৯ জানুয়ারি ব্রিটেনের বিমানবাহিনীর একটি বিমানে হিথ্রো থেকে দেশের পথে যাত্রা করেন বঙ্গবন্ধু। ১০ জানুয়ারি সকালে তিনি নামেন দিল্লিতে। সেখানে ভারতের রাষ্ট্রপতি ভিভিগিরি, প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী, সমগ্র মন্ত্রিসভা, নেতারা, তিন বাহিনীর প্রধান, বরেণ্য ব্যক্তিবর্গ ও ভারতবাসীর কাছ থেকে উষ্ণ সংবর্ধনা লাভ করেন। বঙ্গবন্ধু ভারতের অকৃপণ সাহায্যের জন্য আন্তরিক কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন করেন।
১০ জানুয়ারি, ১৯৭২ বেলা ১টা ৪১ মিনিটে জাতির অবিসংবাদিত নেতা, মুক্তিযুদ্ধের সর্বাধিনায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তার স্বপ্নের মুক্ত স্বাধীন বাংলাদেশের মাটিতে পা রাখেন। পাকিস্তানের বন্দিদশা থেকে বিজয়ীর বেশে এলেন ইতিহাসের মহানায়ক, বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বিকাল ৫টায় তিনি রেসকোর্স ময়দানে (বর্তমান সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে) লাখ লাখ মানুষের উপস্থিতিতে ভাষণ দেন। সশ্রদ্ধচিত্তে তিনি সবার ত্যাগের কথা স্মরণ করেন, সবাইকে দেশ গড়ার কাজে উদ্বুদ্ধ করেন। রাজনীতির ধ্রুপদী কবি বলেন, যে মাটিকে আমি এত ভালোবাসি, যে মানুষকে আমি এত ভালোবাসি, যে জাতিকে আমি এত ভালোবাসি, আমি জানতাম না সে বাংলায় আমি যেতে পারব কিনা। আজ আমি বাংলায় ফিরে এসেছি বাংলার ভাইদের কাছে, মায়েদের কাছে, বোনদের কাছে। বাংলা আমার স্বাধীন, বাংলাদেশ আজ স্বাধীন।

বঙ্গবন্ধু পূর্ব বাংলার স্বাধীনতার সেই সূর্য-পুরুষ, মহান আলোকবর্তিকা- যাকে জেল ও ফাঁসির মঞ্চ কিছুই করতে পারেনি। একটি স্বপ্নের জন্য বারবার জেল (জীবনের প্রায় ১৩ বছর জেলে), নির্যাতন-নিপীড়ন সহ্য করে মহান আলো দিয়ে উদ্ভাসিত করে গেছেন একটি জাতিসত্তাকে, স্বাধীন ভূখণ্ডকে। বঙ্গবন্ধু, মুক্তিযুদ্ধ, বাঙালি জাতিসত্তা, স্বাধীনতা ও বাংলাদেশ এক ও অভিন্ন। মহান স্বদেশ প্রত্যাবর্তন দিবসে বিনম্র শ্রদ্ধা জানাই কালজয়ী সূর্য-পুরুষ, ক্ষণজন্মা রাজনীতির কবি, বাঙালির মুক্তির সারথি, স্বাধীনতার মহান স্থপতি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। অভিনন্দন জানাই বঙ্গবন্ধুকন্যা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনাকে এবং আগামী

প্রজন্মের জন্য নেতৃত্বদানকারী বঙ্গবন্ধুর উচ্চশিক্ষিত সুযোগ্য দৌহিত্রদেরকে। শুভেচ্ছা জানাই সত্যিকারের মুজিব আদর্শ লালনকারী সব মুজিব সৈনিকদের।

এ মাহেন্দ্রক্ষণে স্বাগত জানাই মহান মুজিববর্ষকে। ১০ জানুয়ারি ২০২০ বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন কর্মসূচি দিয়ে মুজিববর্ষ গণনা ও মুজিববর্ষ পালন উৎসব শুরু হয়েছে। মুজিববর্ষ সফল ও সার্থক হোক। মুজিববর্ষ পালনের মধ্য দিয়ে নতুন প্রজন্মের প্রতিশ্রুতি হোক, বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ থেকে তার যাপিত জীবন এবং রাজনৈতিক ও উন্নয়ন দর্শন থেকে শিক্ষা নেয়া ও তার মহান ইতিহাস বিকৃতির চেষ্টাকারীদের প্রতিহত করা। আরও প্রতিশ্রুতি হোক, সুখী-সমৃদ্ধ দেশ গঠনে এবং মাদক-দুর্নীতি-সন্ত্রাসমুক্ত ও শোষণহীন সমাজ গঠনে আত্মনিয়োগের মাধ্যমে বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলার স্বপ্ন বাস্তবায়ন করা।

মুজিববর্ষ পালনের মধ্য দিয়েই বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলা, যেখানে জনমানুষের সত্যিকারের মুক্তি ঘটবে- রচনার পথ প্রশস্ত হোক। এজন্য বঙ্গবন্ধুকন্যা, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে কেবল মুজিব কোট পরিধানকারী নয়, বরং সত্যিকারের মুজিব আদর্শ লালনকারী সোনার ছেলেদের খোঁজার কাজ অব্যাহত রাখতে হবে; যারা নতুন প্রজন্মের জন্য রাজনীতি করবে, যারা জননেত্রীর লক্ষ্য বাস্তবায়নে (অর্থাৎ ২০২১ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে একটি মধ্যম আয়ের দেশ এবং ২০৪১ সালের আগেই উন্নত দেশে পরিণত করতে নিবেদিত ও কার্যকরভাবে কাজ করতে পারবে।

রাজনীতি ও নেতৃত্ব খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয়; মানুষের জীবনমান ও কল্যাণের সঙ্গে সম্পৃক্ত। রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি নিশ্চিত করার পাশাপাশি প্রান্তিক ও সাধারণ জনগণের ক্ষুধা, দারিদ্র্য, অসুস্থতা, নিরক্ষরতা, নিপীড়ন ও বঞ্চনা থেকে মুক্তি গুরুত্বপূর্ণ। এটি একটি দেশের টেকসই বা স্থায়িত্বশীল উন্নয়ন নিশ্চিত করার সঙ্গে সম্পৃক্ত। রাষ্ট্রের মতো একটি সম্প্রদায় বা নির্বাচনী এলাকার ক্ষেত্রেও এটি সত্য।

শুধু রাজনীতির সমালোচনা, গবেষণা, মতামত, নিবন্ধ লেখা বা ওপর থেকে আরোপিত সংস্কারের মাধ্যমে রাজনীতি ও রাজনৈতিক সংস্কৃতির উন্নয়ন ঘটানো যাবে না। রাজনীতির গুণগত পরিবর্তন করতে হলে মেধাবী, প্রতিশ্রুতিশীল ও আদর্শিক তরুণদের রাজনীতির মূলধারায় আসতে হবে। মেধাবী ও আদর্শিক তরুণদের রাজনীতি করার, তাতে টিকে থাকার এবং সংসদীয় রাজনীতিতে অনুপ্রবেশের সুযোগ দিতে হবে। রাজনীতির ভেতর দিয়েই রাজনৈতিক সংস্কার করতে হবে। জয় বাংলা, জয় বঙ্গবন্ধু।

ড. রফিকুল ইসলাম তালুকদার : আহ্বায়ক, বঙ্গবন্ধু পরিষদ, সুনামগঞ্জ জেলা


মতামত জানান :

 
 
 
কপিরাইট © ময়মনসিংহ প্রতিদিন ডটকম - সর্বসত্ত্ব সংরক্ষিত | উন্নয়নে হোস্টপিও.কম